« নীড়পাতা | ওপারে ভাসালে ভেলা »

পাঠ-প্রতিক্রিয়া


কোন পারে ভিড়বে ভেলা?
মারুফ তুষার

ওপারে ভাসালে ভেলা, মাসকাওয়াথ আহসান, জনান্তিক, ফেব্রুয়ারী ২০০৪, ঢাকা।

শুরুতেই স্পষ্ট করে নেয়া ভালো যে এ লেখাটা কোনভাবেই ’সাহিত্য-সমালোচনা’ গোত্রীয় নয়। একজন পাঠক, স্রেফ একজন সাধারন পাঠকের পাঠ- প্রত্রিক্রিয়া।

প্রবাস জীবন এখন আর অ-প্রবাসীদের কাছে তেমন কোন অজানা জগত নয়। এখন এই একুশ শতকে পাকিস্তানের বা ভারতের কিংবা বাংলাদেশের লালমনিরহাট বা অন্য যেকোন প্রত্যন্ত শহর-গ্রামের যেকোন একজন রশিদ বা ইবরাহিম অথবা মেহের নিগারের কাছে জগত অতটা আর বিচ্ছিন্ন, অচেনা নয়। তাদের মধ্যে আমাদের বিপরীতগোলার্ধের মানুষ-শহর-জীবনযাত্রা সম্পর্কে একধরনের ধারনা তৈরী হয়েছে। এই ধারনা তৈরীতে মিডিয়ার একটা বড় ভূমিকা আছে সন্দেহ নেই, তবে তাকে একমাত্র-প্রধান বলে মেনে নেয়া কঠিন। কঠিন একারনে যে, তাহলে সাথে সাথে এটাও ধরে নিতে হবে, মিডিয়ার প্রভাব-আওতার মধ্যে চলে এসেছে আমাদের দেশ এবং উপমহাদেশের প্রত্যন্ত প্রান্তও। কিন্তু আমাদের আর্থনীতিক-সামর্থের সাথে এটা ঠিক খাপ খায় না। তবে বাস্তবে ঘটনাটি যেহেতু ঘটছে, সেহেতু অন্যকোন মাধ্যমের প্রভাবকে বিবেচনায় আনতে হয়। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে যেটা আগে চলে আসে তা হল আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের বিষয়টি।

এদেশের, এউপমহাদেশেরও বটে, যে লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন তাদের মাধ্যমে ব্যক্তিক এবং পারিবারিক পরিসরে সংঘটিত হওয়া যোগাযোগ -যা কিনা বরাবরই সমাজ গবেষকদের কাছে উপেক্ষিত থেকে গেছে- খুব ধীরে কিন্তু বেশ কার্যকরভাবে এদেশের প্রত্যন্ত প্রান্তে ভিনদেশের সংস্কৃতি-ভূগোল-সমাজ-অর্থনীতি সম্পর্কে একধরনের ইমেজ তৈরীতে কাজ করছে। বাংলাদেশের এমন কোন মহল্লা বা পাড়া পাওয়া কঠিন হবে যেখান থেকে একজন মানুষও, কিছুদিনের জন্যে হলেও, উপমহাদেশের বাইরে যাননি। এইসব দুরে চলে যাওয়া, সাগর পার হয়ে যাওয়া মানুষদের যোগাযোগের একপ্রান্ত আটকে থাকে নিজের নিজের দেশের, গ্রামের, পরিবারের মধ্যে। যোগাযোগের সুতো বেয়ে কেবল মাসে মাসে টাকাই আসেনা, আসে - কেমন আছি, কোথায় থাকি, কেমন গরম বা ঠান্ডা পড়েছে এবার- এইসবও। এই দুইপক্ষের মধ্যে বিনিময় হওয়া টেলিফোনসংলাপ, চিঠি, ছবি, পোস্টার, মৌখিক-বিবরন ইত্যাদি দিয়ে বয়ে আসা টুকরো টুকরো জীবনের ছবি নিয়ে নির্মিত হয় একধরনের আবছা অবয়ব। গ্রহীতা-প্রান্তে নির্মিত প্রবাস-জীবনের এই অবয়ব কেবল যার যার পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং তা ক্রমশঃ যোগাযোগের নেটওয়ার্ক বেয়ে ছড়িয়ে যায় বাবার সহকর্মীদের মধ্যে, বোনের বন্ধুদের পরিসরে, ভাইয়ের খেলার মাঠে। কিন্ত গ্রহীতা-প্রান্তে নির্মিত প্রবাস জীবন সম্পর্কে ধারনার সবচেয়ে বড় অসম্পূর্নতা হল এটা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই একপেশে ভাবনার উপর গড়ে ওঠে। বিদেশ থেকে পাঠানো ছেলের বা মেয়ের বা তাদের পরিবারের ফটোগ্রাফে যে সুখি মানুষরা সুন্দর ব্যাকগ্রাউন্ডকে পিছনে নিয়ে হাসিমুখে দাড়িয়ে থাকে তার কোথাও কষ্টের কোন ছাপ থাকে না। কিন্তু বাস্তব এমন নয়, সেখানে কিছু দুঃখও থাকে। এটা ঘটে কারণ, প্রথমতঃ যারা বিদেশে থাকেন তারা নিজেরা, সাধারনত, বলতে চাননা তাদের কষ্টের কথা, দুঃখের কথা।

আবার যারা দেশে থাকেন তারাও ঠিক আশা করেন না যে তারা কষ্টের-দূঃখের কিছু শুনবেন। অনেকসময় কিছু আঁচ করলেও সেটা নিয়ে খুব একটা ঘাটাঘাটি করতে চান না, পাছে যে ছেলেটার পাঠানো টাকায় সংসার চলছে তাকে বিদেশে থাকতে বলার নৈতিক জোরটা কমে আসে। তারপরেও, বিদেশে থাকাটা যে কষ্টের - এরকম যে একেবারে কেউ ভাবেননা তা নয়, অনেকেই মনে করেন, জানেন যে বিদেশে বসবাস অনেক কষ্টের। তবে সেই ধারনাটাও প্রধানতঃ শারীরিক কষ্ট সংক্রান্ত ঃ কাজের লোক পাওয়া যায় না, নিজের কাজ নিজে করতে হয়, প্রচন্ড ঠান্ডা/গরমে কাজ করতে হয় ইত্যাদি। কিন্তু এইসব কষ্টের বর্ননার মধ্যেও আসল কষ্টের কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। প্রবাসে মানুষ প্রচন্ডভাবে একা, বিচ্ছিন্ন্ এবং নিঃসঙ্গ। মাসকাওয়াথের ওপারে ভাসালে ভেলায় স্বদেশ থেকে অনেক দুরে বসবাসকারি একদল মানুষ, তাদের বিচ্ছিন্নতা আর এই বিচ্ছিন্নতা থেকে বেয়েওঠা নিঃসঙ্গতা, একাকিত্বের কষ্টটাই মূলসুর হয়ে বেজেছে পুরো উপন্যাসে১।

অবশ্য এটা এমন কোন অভিনব আবিস্কার নয় যে প্রবাসজীবন, বেশীরভাগক্ষেত্রেই, ভয়ঙ্কর রকমের নিঃসঙ্গ। এ বিষয়ে অন্যরাও অনেকে লিখেছেন। তারপরও পশ্চিমের জীবন সম্পর্কে বাজারচলতি যে ধারনা রয়েছে সেখানে একাকিত্বের সমস্যাটি তেমন একটা কল্কে পায় না। সাধারনতঃ এটাই মনে করা হয় যে উন্মুক্ত, স্বচ্ছল এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা-রক্ষিত সমাজে এধরনের বিচ্ছিন্নতা বোধ করার তেমন জোরালো কোন কারণ নেই। অনেকে এটাও ভাবেন, ”অসুবিধা কি, কাজ করলাম, টাকা আয় করলাম, সন্ধায় পাবে গেলাম, প্রয়োজনে বান্ধবী যোগাড় করলাম, ব্যাস! চমৎকার জীবন! একা হওয়ার সময় কোথায়?” তবে মাসকাওয়াথ যে জীবন আমাদের সামনে টেনে এনেছেন সেখানে প্রতিটা চরিত্রই এক একটা বিচ্ছিন্ন ভেলা। সেখানে কখনও পরস্পরের মধ্যে ঠোকাঠুকি হয়, কখনও একটুক্ষনের জন্য হয়তবা পাশাপাশিও চলে। কিন্তু, শেষপর্যন্ত, গন্তব্যের পথে দীর্ঘযাত্রায় কেউ কারো সহযাত্রী নয়।

মাসকাওয়াথ ওপারে ভাসালে ভেলায় যাদের কথা বলেছেন, বিশেষ করে প্রধান চরিত্রগুলো, তারা সবাই ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ। জার্মানীর উত্তর-পশ্চিম অংশে রাইন-তীরের শিল্পশহর কোলন। সেখানে বিভিন্ন কাজে, বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশের মানুষ এসে জড় হয়েছে। একদিন এইশহরে চাকরী নিয়ে আসে পাকিস্তানের তরুণী মারভি। আত্মবিশ্বাসি, স্বাবলম্বী এবং বাইরে কাজ করায় দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থাকা সত্বেও অচেনা এক শহরে, নি:সঙ্গ এক ঘরের মধ্যে মারভি প্রচন্ড একা বোধ করে। তারপর ক্রমশঃ সহকর্মীদের সূত্রে, রাস্তায় দেখাহওয়া-পরিচয়হওয়ার সুবাদে আরো অনেকের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এভাবেই বন্ধুত্ত¡ তৈরী হয় বাংলাদেশের নাইম, ভারতের রাজশ্রী’র সংঙ্গে। ঘনিষ্ঠতা তৈরী হয় মিসেস খৈয়ামের সাথে। লেখাটিতে ঠিক কোন একটা কেন্দ্রীয় গল্প নেই যেটা মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট রেখা বরাবর এগিয়ে গেছে বলে ধরা যেতে পারে। এখানে অনেক টুকরো গল্প আছে, কিন্তু সেগুলোর সবগুলোই স্বয়ংসম্পূর্ন, আলাদা। টুকরো গল্পগুলোর পরস্পরের মধ্যে কোন তেমন যোগাযোগও নেই। সেগুলোর বেশীরভাগই সময় এবং কালের ভিন্ন ভিন্ন তলে ঘটে যাওয়া। আর যেহেতু ও ধরনের কোন একক গল্প নেই সেহেতু লেখাটিতে তেমন কোন উত্থান-পতনও দেখা যায়না। মূলতঃ লেখাটি কোন কাহিনী-বর্ননা না হয়ে, বরং, গড়ে ওঠে একটি উত্তরআধুনিক সামাজিক কাঠামোর ভেতর যেকোনকারণে-হোক-হাজির-হওয়া ভিন্ন ধরনের মূল্যবোধ বহনকারী কিছু মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা আন্তঃসম্পর্কের উপস্থাপন হিসেবে। ফলে লেখাটিতে বেশীরভাগক্ষেত্রেই, চরিত্রগুলো এবং তাদের পরস্পরের মধ্যকার আন্তঃক্রিয়াসমূহ প্রচন্ডভাবে বর্তমান। সেগুলো কারন-ফলাফল সম্পর্ক দ্বারা প্রভাবিত নয়। যদিও নাইম এবং মারভির বন্ধুত্ত¡ অন্যান্য সম্পর্কগুলো থেকে আলাদা হয়ে, প্রধান হয়ে উঠতে চায় তবে সেটিও শেষপর্যন্ত একটি উপমহাদেশীয় প্রটোটাইপ সম্পর্কের বাইরে এসে কোন বিশেষমাত্রা যোগ করে না।

ওপারে ভাসালে ভেলা’য় প্রধান চরিত্রগুলোর প্রায় সকলেই পশ্চিমে, কম-বেশী, অনেকদিন থাকলেও তারা এখোন পর্যন্ত মানসিকভাবে তেমন একটা বদলাননি। যেমন মারভি তার সংস্কার ধরে রাখেন, মিসেস খৈয়াম ড্রইংরুমকে ইসলামাবাদ বানান, বিজন স্যানাল পরাজিত স্বপ্নের আশ্রয় খোঁজেন কবিতায়। মোটের উপর এই চরিত্রগুলো যে যেভাবে এসেছিলেন প্রায় সেরকমই রয়েগেছেন, অনেকবছর পরেও, একটা ভিন্ন বাস্তবতায় বাস করা সত্ত্বেও। এটা ঘটা একটু কঠিন। তবে সেটাও ঘটতে পারে, একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। মূলতঃ এই ব্যাপারটির ব্যাখ্যা পাওয়া যায় সমাজমনোবিদদের আলোচনায়। তাদেরমতে, এটা ঘটে যখন ব্যক্তির সংস্কৃতি এবং বৃহত্তর সমাজের সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্যটা অনেক বেশী হয়ে যায়, তখন সাধারনত: নিজেকে গুটিয়ে নেয় নিজের ভেতর, নিজের চারপাশে একধরনের রক্ষনাত্মক ব্যূহ তৈরী করে। স্বপ্ন ও বাস্তব মিলিয়ে একধরনের পরাবাস্তব জগত তৈরী করে। বিজন স্যানাল বা মিসেস খৈয়াম এধরনের মানুষের উদহারন।

ওপারে ভাসালে ভেলা’য় দেখা যায়, বাঙালী, অবাঙালী, হিন্দু, মুসলমান, ভারতীয়, পাকিস্তানি ইত্যাদি পরস্পর বিরোধী পরিচয় - যাদের সহাবস্থান অনেকসময়ই সহজ নয়- নিয়েও একদল মানুষ একটা নতুন ধরনের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। অনেকে এটাকে একটা ভিন্ন সমাজ ও বলতে পারেন, তবে আমি এটাকে একটা নেটওয়ার্কই বলবো। সকল সমাজও শেষপর্যন্ত একটা যোগাযোগ নেটওয়ার্কই বটে। একটা নেটওয়ার্কের সদস্যপদ, পালনীয় নর্মস, আইনকানুন যখন নির্দিষ্ট হয়ে যায় এবং সদস্যদের মধ্যে সেগুলো সম্পর্কে একধরনের সাধারন গ্রহনযোগ্যতা গড়ে ওঠে তখন সেটা নেটওয়ার্ক থেকে সমাজে রূপান্তরিত হয়েছে বলা যায়। নেটওয়ার্ক তূলনামূলকভাবে কমস্থায়ী। কোলন শহরের বসবাসকারী উপমহাদেশীয় মানুষদের নিয়ে বিকশিত নেটওয়ার্কটির মধ্যেও ক্রমশ: সৃষ্টি হয়েছে ভালোমন্দ, ন্যায়-অন্যায় বোধ, প্রত্যাশা, বিধিনিষেধ। এগুলো সবই অলিখিত , অপ্রকাশিত কিন্ত কার্যকরভাবে বিদ্যমান।

সেজন্য মিসেস খৈয়ামের অনেককিছু ভালো না লাগলেও মারভি তাকে মুখের উপর কিছু না বলতে পারে না, সেকারণেই অর্থহীন বোধ করলেও নাইমকে বিভিন্ন বাসায় যেয়ে পানাহারের নিমন্ত্রন রক্ষাকরতে দেখা যায়। এই মানুষেরা ধর্ম, সংস্কৃতি, বেড়েওঠা ইত্যাদি বিবেচনায় একজন আরেকজন থেকে অনেক দূরের কিন্তু তারপরেও প্রবাসে এসে একধরনের ’কমন আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ গড়ে নিয়েছেন। তৈরী হয়েছে একনতুন ধরনের স¤প্রদায়। প্রথাগতভাবে এইজাতিয় একটি নেটওয়ার্ককে স¤প্রদায় বলা যাবেনা, কিন্তু এটাকে যদি বৃহত্তর জার্মান স¤প্রদায়ের পাশাপাশি রাখা যায় তাহলে কিন্তু ঠিকই এর একটা স্বতন্ত্র চেহারা চোখে পড়বে। আগ্রহের ব্যাপার হল, উপমহাদেশীয় এই স¤প্রদায়টি কিন্তু দারুণভাবে অর্গানিক। কিন্তু তা কেবল নিজেদের মধ্যে। অর্থাৎ নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের বিকাশ, টানাপোড়েন, পরস্পরকে বোঝা, পরস্পরের অবস্থান সম্পর্কে ধারণার গভীরতা ইত্যাদি বিষয়গুলোতে চমৎকারভাবে সক্রিয়, সংবেদনশীল। কিন্ত বাইরের সমাজ সম্পর্কে অ¯পষ্ট ধারনা, আন্ত-ক্রিয়ার অভাব ইত্যাদির কারনে উপমহাদেশের বাইরের চরিত্রগুলোর সাথে যোগাযোগ তেমন ঘটেনা বললেই চলে। নিজেদের তৈরী করে নেয়া নেটওয়ার্কের বাইরে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সবাই কমবেশী নিস্ক্রিয়, কেবল দর্শকমাত্র। নিজেদের নেটওয়ার্কের মাত্র গুটিকয় মানুষের বাইরে যে বিরাট কোলন শহর রয়েছে, সেখানে হাজার হাজার মানুষ রয়েছে উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সাথে তাদের দেখা হয় কেবল বাসে-ট্রামের পাশের যাত্রী অথবা কনসার্ট-কার্নিভালের জনতা হিসেবে।

মাসকাওয়াথের অন্যান্য লেখার (আকাঙ্খাকার শহর, বিষন্নতার শহর ও অন্যান্য) সাথে যাদের পরিচয় আছে তারা নিঃশ্চয় খেয়াল করেছেন, সে গল্পের অনুপুঙ্খ দীর্ঘ বর্ননায়, কাহিনী-বিস্তার বিকাশে বা কোন একটি চরিত্রের ডিটেইল নির্মানে তেমন একটা আগ্রহী নন। বরং, যেন খুব দ্রুতহাতে সাদা কাগজের উপর পেন্সিল দিয়ে ফুটিয়েতোলেন এক একটা কাহিনী-স্কেচ। যদিও এই দ্রুত-হাতে টানা ব্রাশের কারনেও প্রতিটি চরিত্রের প্রতি লেখকের যে অশেষ যতœ ও সহানুভূতি রয়েছে তা একটুও ঢাকা পড়েনা। ঢাকা পড়েনা লেখকের সুক্ষ রসবোধও। মাসকাওয়াথ বেশ সচেতনভাবেই তার এই বিশেষ ধরনটি গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। নিজের স্বপক্ষে তার পর্যবেক্ষনটাও একেবারে ফেলে দেয়ারমত নয়, ‘...এখানে যা কিছু ঘটে তা দিয়ে ঘটনার বর্ননা হতে পারে, কিন্তু ঐ ঘটনাগুলো জোড়া লাগালে কোন কাহিনী হয়ে ওঠেনা...কিংবা আমরা যারা বিচ্ছিন্ন সময়ের অভিঘাতে বেড়ে উঠছি তাদের লেখা ক্রমাগত বিচূর্নীভাবণার লেখা হয়ে উঠবে..’ (মাসকাওয়াথ ২০০৪, ভুমিকা)। লেখার এই ধরনটির বৈশিষ্ঠ্য হলো তা আনুভূমিকভাবে যতটা বাড়ে লম্বিকভাবে ততটা নয়। ফলে কোন একটি চরিত্রের বা কাহিনীর গভীরতা সম্পর্কে পাঠকের অতৃপ্তি মেটানোর কোন সুযোগ থাকে না। এবং সেই সুবাদে কেউ কেউ লেখকের পর্যবেক্ষন বা/এবং প্রকাশ-ক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নিতে পারেন। ওপারে ভাসালে ভেলায় নাইম, যামিনী বা পারমিতা চরিত্রগুলি এরকম কমপ্রেশনের শিকার হয়েছে বলে মনে হয়।

ওপারে ভাসালে ভেলা সম্পর্কে শেষ পর্যবেক্ষনটি হলো, এ উপন্যাসে যাদের প্রবাসজীবন উঠে এসছে, তারা কিন্তু উপমহাদেশের যে লক্ষ লক্ষ মানুষ বিদেশ-বিভূঁয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে জীবিকা অর্জন করছেন এবং নিজের নিজের দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছেন তাদের প্রতিনিধিত্ব করে না। পশ্চিমের সবদেশেই ইমিগ্রান্টরা মূলতঃ কায়িকশ্রমের সাথে যুক্ত। তাদের অনেকেই সপ্তাহের সাতদিনই কাজ করেন, বড় পরিশ্রমের সেই কাজ। প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামটা তাদের রীতিমত গায়ের উপর দিয়ে যায় এবং যেহেতু ইমিগ্রান্টের বৈধ মর্যাদা অর্জন করাটাও একটা অত্যন্ত কঠিন-জটীল-দীর্ঘমেয়াদী প্র্রক্রিয়া সেখানে এর মধ্যে দিয়ে আসা এইসব মানুষের জীবন-অভিজ্ঞতা অনেকবেশী জীবন্ত, তাঁজা। বৃহত্তর সমাজের (যেমন: কোলনের জার্মান সমাজ) সাথে তাদের যোগাযোগের পরিমান-ধরন অনেক বেশী নিয়মিত এবং প্রত্যক্ষ। তাদের পক্ষে জীবনযাপনটা কেবলমাত্র নিজস্ব সাংস্কৃতিক সীমায় আবদ্ধ রাখা অনেকসময়ই সম্ভব হয় না। ফলে, এই শ্রেণীর মানুষের প্রবাস-অভিজ্ঞতা, উপন্যাসে যাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে তাদের তূলনায়, অনেকটাই ভিন্ন।

মাসকাওয়াথ এই জীবনটাকে পাশ কাটিয়ে গেছেন তার লেখায়। নাগরিক জীবনের সংকটই মাসকাওয়াথের লেখার মূল বিষয়, তবে সেই জীবনটা নেহায়েৎই মধ্যবিত্তের। মধ্যবিত্তের জীবনের যে সমস্ত দ্বিধা, অনিশ্চয়তা সারাজীবন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় সেটাই নাইমকে বেশী সাহসী হতে বাধা দেয়, আগামী শীত বা বসন্তের স্বপ্ন দেখেতে ততটা ভরসা পায় না। আর এই অনিশ্চয়তাই ভেসে যাওয়া ভেলার গন্তব্য সম্পর্কে আমাদের কোন ধারনা দেয় না। অস্পষ্ট থেকে যায় কোনএকটি সম্পর্কের পরিনতি কি দাড়াতে পারে, বিজন স্যানাল, দেবুদা বা সেজান বা যামিনী চরিত্রগুলো জীবনটাকে কোনদিকে নিয়ে যেতে পারে। তাই, শেষপর্যন্ত, পাঠক কেবল ভেলার ভেসে যাওয়া দেখে, কোন পারে ভিড়বে ভেলা প্রশ্নটা তার মনে থেকেই যায়।পাঠ-প্রতিক্রিয়া

[1 ওপারে ভাসালে ভেলা আদৌ উপন্যাস কি না, হলেও কি ধরনের উপন্যাস ইত্যাদী প্রশ্নের উত্তর দেয়া এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। এখানে লেখাটিকে উপন্যাস হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে, মূলতঃ এই বিচারে যে, এটাকে লেখক উপন্যাসই বলতে চেয়েছেন। আগ্রহীদের জন্য নাম-ভূমিকা পৃষ্ঠা দ্রষ্ট্যব্য।]

- রিভিউটি লিখেছেন : মারুফ তুষার

"ওপারে ভাসালে ভেলা" বইটির পিডিএফ ভার্সন এখানে